এক একটি খণ্ড এক কেজি থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত। দেখতে মনে হবে একটি ‘মধুখণ্ড’। দেখতে এতটাই ঝকঝকে যেন এপাশ ওপাশ দেখা যাবে। গুড়ের এখণ্ড থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস ঝরছে। একটুখানি চেখে দেখার লোভ সামলানো কষ্টকর। মাদারীপুরের চিরচেনা সেই পাটালি গুড়ের ঐতিহ্য এখন হারাতে বসেছে। গেলো কয়েক দশক ধরে ব্যাপক সুখ্যাতি থাকলেও এখন অতিরিক্ত লাভের আশায় ভেজাল দেওয়ায় সেই সুনাম নেই বললেই চলে। ফলে কমেছে পাটালি গুড়ের কদর। কেনাবেচায়ও পড়েছে ভাটা। অনেক ব্যবসায়ি চলে যাচ্ছেন ভিন্ন পেশায়। অন্যদিকে প্রশাসনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, জেলার ব্রান্ডিং পাটালি গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। তাই নিয়েছেন নানা উদ্যোগও। মাদারীপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের পাঁচখোলা ইউনিয়নের জাফরাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খুব ভোরে আলোর ফোটার সঙ্গে সঙ্গে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত লোকমান শিকদার ও তার ছেলে আল-আমীন। এক একটি গাছ থেকে আধা হাঁড়ি রস পাচ্ছেন। সেই রস চুলায় টিনের তৈরি তাফালে ঢেলে রস থেকে গুড় তৈরিতে লেগে পড়েন তার স্ত্রী আমেনা খাতুন। এক থেকে দেড় ঘণ্টা জ্বালানোর পরে রস লাল হয়ে গুড় তৈরি হয়। সেই গুড় আপন মনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করে গুড়ের লালী। সেই লালী গুড় ছোট বড় মাটির পাত্রে ঢেলে তৈরি করা হয় এক থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত গুড়ের খণ্ড। এসময় কথা হয় লোকমান শিকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর কার্তিকের শেষ থেকে ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খেজুর গুড়ের মৌসুম। এ মৌসুমে খেজুর গুড়ের মৌ-মৌ গন্ধে পাওয়া যেতো আবহমান বাংলার প্রকৃত রূপে। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে গরম গুড়ের পাটালি ও লালী গুড়ের লোভনীয় স্বাদ ভোলার নয়। চুলার পাশে বসে মুড়ি মাখিয়ে খাওয়ার স্বাদই ছিল আলাদা। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা কারণ ও যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে নীতি-হীন একশ্রেণির মানুষের ভেজালের কারণে ধ্বংস হতে শুরু করেছে সেই ঐতিহ্য। যে কারণে ভেজালমুক্ত গুড় এখন আর আশা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তার ছেলে আল-আমীন বাবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘ভেজালের কবলে পড়ে মাদারীপুর জেলার খেজুর গুড় তার নিজস্ব গুণাবলী হারাতে বসেছে। দিন দিন মুনাফাখোর ও অসাধু গুড় উৎপাদনকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠায় গুড়ের হারানো ঐতিহ্য আর ফিরিয়ে আনা কষ্টকর। তাই আমরা কয়েকটি পরিবার কোন রকম টিকে আছি। আগামীতে হয়ত আমরাও টিকে থাকতে পারবো না। এতে সেই আগের রসনাবিলাস থেকে বঞ্চিত হবে শহুরে মানুষ।’ রাজৈর উপজেলার নুরপুর গ্রামের গাছি ফজলুল হক বেপারী বলেন, ‘নানা কারণে গ্রামগঞ্জ থেকে ক্রমেই খেজুরগাছ কমে যাচ্ছে। আগে খেজুরের রস ও গুড় খেতে বাড়ির আশপাশে খেজুরের গাছ লাগাতো। নানা ফলের বাহারে ও কৃত্রিম রসে সহজলভ্যতায় খেজুর গাছ লাগানোর প্রতি এখন আর তেমন আগ্রহশীল নয়। ইজি বাইকসহ টাকার আয়ের পথ থাকায় এখন তেমন কেউ গাছের ওঠার মত এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আসতে চায় না।’ এসএম আরাফাত শরীফ বলেন, ‘ভেজাল গুড়ে এখন হাট-বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গুড়ের ওজন বাড়াতে চিনি আর রং ফর্সা করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। যে কারণে সুস্বাদু খেজুর গুড় এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। গত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এ অবস্থা চলে এলেও নেওয়া হয়নি আইনি ব্যবস্থা। তাই গুড় বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের আগের মতো ব্যবসা নেই। ফলে অনেকেই চলে গেছে অন্য পেশায়। আমরাও বঞ্চিত হচ্ছি মধুখন্ড পাটালি গুড় থেকে।’ আর মাদারীপুর জেলার ব্রান্ডিং পাটালি গুড়ের ঐতিহ্য ফেরাতে কৃষি অফিস থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সেইসঙ্গে ভ্রামমাণ আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা, এমনটারই আশ্বাস জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক দিগ্বিজয় হাজরার। তিনি বলেন, ‘যারা ভেজাল গুড় তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সহযোগিতায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা কৃষি অফিস থেকেও কৃষকদের ভেজাল গুড় উৎপাদন করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যদি কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আবহমান বাংলার পৌষ-পার্বণের উৎসব আর শীতের পিঠা-পায়েস ও লোককথাদের যেন ভুলতেই বসেছে বাঙালিরা। প্রতি বছর জেলায় অন্তত তিন থেকে চার কোটি কাটার গুড় বিক্রি হয় বলে দাবি, গুড় ব্যবসায়ীদের। তাই তো নির্ভেজাল গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ আগের মতো পাইতে খেজুর গাছ ও গাছির সংখ্যা বাড়ানোর কথা জানালেন জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর জেলার ব্রান্ডিং হচ্ছে খেজুর গুড়। তাই ঐতিহ্য আর সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্যে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতি উপজেলায় বিনামূল্যে খেজুর চারা বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া গাছিরা যাতে উৎসাহ পায়, সেজন্যে গাছিতের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। আগামীতে গাছিরা যেন নিচে বসেই রস সংগ্রহ করতে পারে, সে বিষয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’