আসলেই কি সময় পাল্টে গেছে? এখন আর কাউকেই টেবিল চাপড়িয়ে আড্ডা দিতে খুব একটা দেখা যায় না। মানুষ সত্যই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ প্রবণতা দিন দিন মানুষকে সঙ্গীহীন এবং একা করে দিচ্ছে। অথচ সৃষ্টিশীল যে-কোনো কাজের জন্য আড্ডা অপরিহার্য। শিল্প-সাহিত্য তো বটেই, সাধারণ জানাশোনার জন্যও দরকার হয় আড্ডার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্যাফেটেরিয়াভিত্তিক আড্ডা হয়। এর মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টের বিশ্বখ্যাত ক্যাফেটেরিয়া হল নিউইয়র্ক ক্যাফে। এখানে ১২০ বছর ধরে সগৌরবে চালু রয়েছে আড্ডা। সেখানকার প্রখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-ভাস্কর এ ক্যাফেটেরিয়ায় এসে আড্ডা দেন। এ রকম আরও একটি আড্ডা হয় মিসরের রাজধানী কায়রোয়। স্থানীয় ক্যাফে নাইলে নাগিব মাহফুজ ওই দেশের তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আড্ডা দেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
তবে ঠাকুরবাড়ির আড্ডার কথা আমাদের কম-বেশি জানা। সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকে আড্ডার রেওয়াজ চালু রয়েছে। জোড়াসাঁকোর দোতলায় রবীন্দ্রনাথের বসবার ঘরে বেশ ক’জন অধ্যাপকসহ লেখকরা নিয়মিত আড্ডা দিতেন। তা ছাড়া শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের কোণার্ক বাড়িতেও জমজমাট আসর বসত। আড্ডায় শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গ তো থাকতই, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিও সমান গুরুত্ব পেত। এর সঙ্গে উপরি পাওনা হিসাবে থাকত নানা সরস কৌতুক। এ রকম এক আড্ডায় একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমরা কী জানো, এ রুমে একটি বাঁদর আছে। শব্দটা আড্ডাস্থলে রীতিমতো বোমা ফাটায়। হঠাৎই চমকে ওঠেন সবাই। কথা বলাও থেমে যায়। একজন আর একজনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, গুরুদেব এ কী বললেন! আড্ডাস্থলে যেন নেমে আসে গভীর নীরবতা। বিষয়টি দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোঁফের আড়ালে তার হাসি আর চেপে রাখতে পারছিলেন না। শব্দ করেই হেসে উঠলেন তিনি- বললেন, এ রুমের বাঁ-দিকে একটা ‘দোর’ অর্থাৎ দরজা আছে। সভায় তখন আবার জেগে ওঠে হাসির রোল। সন্দেহ নেই, এ ধরনের সরস কৌতুক একঘেয়েমি দূর করে আড্ডায় ফিরিয়ে আনে সঞ্জীবনী শক্তি।
নাটরের মহারাজা জগদানন্দ রায়ের তত্ত্বাবধানেও আড্ডার আয়োজন ছিল। সেই আড্ডায় অংশ নিতেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। রাখালদাস ছিলেন সুরসিক মানুষ। স্বল্পভাষী হওয়া সত্ত্বেও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ আড্ডায় একাকার হয়ে যেতে সময় নিতেন না মোটেও।
কল্লোল যুগে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ ও বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ এবং পাশাপাশি ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম’ ও ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি পত্রিকাগুলো ঘিরে ভিন্ন ভিন্নভাবে আড্ডা হতো। এসব আড্ডা রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে এসে আধুনিক কবিতার জগৎ তৈরির ক্ষেত্রে রাখত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। আর এর কাণ্ডারিরা হলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চত্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ।
আরও এক আড্ডার খবর জানা যায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে। সেখানে নিয়মিত উপস্থিত হতেন প্রবোধকুমার স্যান্নাল, প্রমথনাথ বিশী, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত। গজেন্দ্রনাথ মিত্র আর সুমথনাথ ঘোষকে ঘিরে এ আড্ডায় আরও উপস্থিত হতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃতি কলেজ থেকে সুশীলকুমার দে। এর অনেক পরে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে ‘কৃত্তিবাস’-এর আড্ডাটিও বেশ আলোচিত হয়। ‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে উন্মাতাল হয়ে উঠেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন তার সঙ্গে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায় প্রমুখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা পত্রিকা হিসাবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকৃত অর্থে পরিকল্পিতভাবে সাহিত্যের আড্ডা তেমন একটা হতো, বলা যায় না। হ্যাঁ, সাহিত্যের অনুষ্ঠান মাঝেমধ্যে হতো, আর সেখানে বজায় থাকত গুরুগম্ভীর পরিবেশ। তবে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বিশেষ একজনকে ঘিরে সাহিত্যের আড্ডার খবর যাওয়া যায়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের লেখকরা বিশেষ করে কবিরা নির্দিষ্ট সময়ে আড্ডা দিতেন পুরানা পল্টনের গাজী শাহাবুদ্দীনের কথাকলি প্রেসে। তাদের আড্ডার আর একটি জায়গা ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত রেস রেস্টুরেন্ট। এ দু’স্থানে বসে চুটিয়ে সাহিত্যের আড্ডা হতো। এ আড্ডার শিরোমণি থাকতেন অবশ্যই শামসুর রাহমান। তাকে কেন্দ্র করেই সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ তুখোড় আড্ডায় মেতে উঠতেন। কখনো কখনো এ আড্ডা দীর্ঘ সময়জুড়ে চলত।
তবে নিউ মার্কেটের ভেতরে অবস্থিত ‘মণিকো’ রেস্টুরেন্টের কথা আলাদা। এ রেস্টুরেন্ট প্রতি রবিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর অবধি কবিদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে থাকত। কী না আলোচনা হতো সেখানে। যেমন ব্রিটিশ কবি টেড হিউসের কবিতা নিয়ে শহীদ কাদরীর গভীর আগ্রহের কথা কে-না জানতেন। শহীদ ভাইয়ের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, টেড হিউসের কবিতায় আছে ইন্দ্রিয়ঘন স্পর্শ আর চিত্রকল্পের আশ্চর্য প্রয়োগ। তার কবিতায় উজ্জ্বল বাকভঙ্গির মধ্য দিয়ে লাভ করা যায় নতুন নতুন উপলব্ধির পরিচয়। নানা কথার ভেতরে উঠে আসত বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি আধুনিক কবিতার প্রধান পুরুষদের প্রসঙ্গ। শিল্প-সাহিত্যের জন্য বিশ শতক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিএস এলিয়ট, ডব্ল্যু বি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, প্রেভ প্রমুখ কবি ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিকতাকে ঝেঁটিয়ে দূর করে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিকতাকে তা উঠে আসে এসব আলোচনায়। সেখানে হাজির থাকতেন রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, অরুণাভ সরকার, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, রাজীব আহসান চৌধুরী, সানাউল হক খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, জাহিদুল হক, অসীম সাহা, মাশুক চৌধুরী, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, জাহাঙ্গীরুল ইসলাম, আবু করিম, মোস্তফা মীর, সাবদার সিদ্দিকী, হাফিজুর রহমান, মেস্তফা মহিউদ্দীন, শাহাদাত হোসেন বুলবুল, মাহবুব হাসান, হাসান হাফিজসহ আরও অনেকে।
‘মণিকো’ রেস্টুরেন্টকে ঘিরে এ আড্ডায় একবার ‘মতো’ শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে তুখোড় অলোচনায় হয়। জীবনানন্দ দাশ ‘মতো’ শব্দটি কবিতায় যেভাবে প্রয়োগ করেছেন এবং বহুল ব্যবহার করেছেন, তাতে তিনি শুধু সফলই হননি, নিজেকেও তুলে এনেছেন মৌলিক প্রতিভার সমুজ্জ্বল উচ্চতায়। উপমা আর চিত্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘মতো’ শব্দটি প্রয়োগ করে জীবনানন্দ দাশ কবিতা পাঠককে চেতনার নানামুখি স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে ‘মতো’ জীবনানন্দ দাশের একান্ত নিজস্ব শব্দ বলেই হতো বিবেচিত। উত্তরসূরি হিসাবে আমাদের কী উচিত হবে ওই শব্দ ব্যবহারের দুঃসাহস দেখানো? প্রশ্নটি তাদের উদ্দেশেই করা হতো যারা জীবনানন্দ দাশের অনুকরণে ‘মতো’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করেন। এ রকম এক এক রোববারে এক একটি ইস্যু নিয়ে বয়ে যেত আলোচনার ঝড়। সে সময় জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকাগুলোয় রবিবারেই বেরোত সাহিত্য পাতা। তাতে প্রকাশিত কবিতাগুলোও এ আলোচনায় কখনো কখনো উঠে আসত। অনেক তরুণ কবি তো সপ্তাহের এ দিনটির জন্য থাকতেন অপেক্ষায়। তাদের আকর্ষণের একমাত্র কারণ, এ আড্ডার ভেতর দিয়ে লাভ করা যেত নিজেকে ঋদ্ধ করার সুযোগ। এভাবে প্রতি রোববারই ষাট এবং সত্তর দশকের অধিকাংশ কবির পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠত পুরো নিউমার্কেট।
ঢাকার আরও একটি আড্ডাস্থল ছিল শহীদ কাদরীর পুরানা পল্টনের বাসস্থান। সেখানে ষাটের দশকের আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক যে-দিন হাজির থাকতেন, সেদিন আড্ডা সত্যই নতুন একটা মাত্রা লাভ করত। শহীদ কাদরীকে ঘিরে জমে ওঠা এসব আড্ডায় একই সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন সত্তরের দশকের তরুণ কবিরাও।
সবাই যেহেতু কবি, তাই সেখানে কবিতার বিষয় নিয়ে কথা হবে- এটাই স্বাভাবিক। হয়তো আলোচনায় উঠে আসল রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে বাংলা আধুনিক কবিতার ভিত্তি গড়ে তোলা প্রধান নায়কদের প্রসঙ্গ। ত্রিশের দশকের পঞ্চ-পাণ্ডব অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে তো আছেনই, আরও আছেন সে-সময়েরই গুরুত্বপূর্ণ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ। এদের সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দের বক্তব্য হল, তারা আধুনিক কবিতার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন সত্য, আরও বড় সত্য হলো, চিন্তা-চেতনায় তারা কেউ কারও অনুগামী নন। প্রত্যেকেই নিজ আলোয় আলোকিত। এভাবেই আড্ডা এক একদিন ঘন দুধের সরে রূপ নিত।
গত শতকে সত্তরের দশকে আড্ডার আরও একটি আকর্ষণীয় জায়গা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পাশে, নাটমণ্ডলের উত্তরে পাশাপাশি দুটি কাঁচা ঘরে চা-নাস্তার দোকান ছিল এক সময়। পুব পাশেরটি হলো শরীফ মিয়ার। এখানেই ভিড় উপচে উঠত। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের বৈশিষ্ট্য হলো খাবারের মান ভালো। তা ছাড়া, দুপুরে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে থাকত খাসির মাংসের তেহেরি। ভীষণ চাহিদা ছিল এর। ষাট আর সত্তর দশকের কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল ছিল এ শরীফ মেয়ার ক্যান্টিন।
সবচেয়ে মজার আসরটি বসত বাংলা একাডেমির চতুর্থ তলায়, কবি রফিক আজাদের রুমে। সরস কথা-বার্তার ভেতর দিয়ে কবিতার গভীরতর বিষয় খুব সহজেই উঠে আসত। সেখানে আসতেন ষাট ও সত্তর দশকের কবিরা। আসতেন সাহিত্যের অন্যান্য শাখার কৃতীপুরুষেরাও। ‘উত্তরাধিকার’-এর সার্বিক দায়িত্ব ছিল রফিক আজাদের ওপর। লেখা জমা দেওয়া ছিল একটি কারণ। সে যাই হোক, কথামালা কিন্তু সচল থাকত অবিরাম। আড্ডার এক পর্যায়ে রফিক আজাদ বললেন, ‘কবিরোগ’ সারানোর ওষুধ তার কাছে আছে! জিজ্ঞেস করা হলো, সেটা আবার কী?
রফিক আজাদ বললেন, একবার এক যুবক আমার কাছে এসেছিল কবিতা ছাপানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। তার কবিতা পড়ার পর মনে হল, তাকে দিয়ে আর যাই হোক কবিতা হবে না। বুঝলাম তাকে কবিরোগে পেয়েছে। এই বাতিক দূর করবার জন্য মজা করে বললাম, বাবা কবিতা লিখতে চাও?
উত্তর দিলো, জি!
-তাহলে তো তোমাকে এখন থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে-এর কবিতা বেশি করে পড়তে হবে!
রফিক আজাদকে প্রশ্ন করা হল, এ পরামর্শ কেন দিলেন?
বললেন, ওই দুই কবিই কবিতায় প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। এসব শব্দের অর্থ খুঁজে বের করতে করতে এক সময়ে দেখা যাবে, তার কবিতা লেখার সখ পালিয়ে গেছে।
আড্ডায় হাসি যেন আর থামতেই চায় না।
এ ধরনের আড্ডা এখন চোখে পড়ে না। শুধু হয় সাহিত্যের অনুষ্ঠান। সেখানে অনুষ্ঠানের রীতিনীতিই বেশি অনুসরণ কর হয়। ফলে আড্ডার আমেজ কোথাও খুঁজে পাওয়া না। আসলেই পাল্টে গেছে সময়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি