ফুটফুটে গারো শিশু রাজ নকরেক। দুই বছর আগেও মাতৃভাষা মান্দিতে কথা বলতে পারত না। গলা দিয়ে বের হতো না সব শব্দ। মা লিপমা নকরেক এবং বাবা জেনাবর্ধন দালবতের কর্মসংস্থান রাজধানীতে হওয়ায় গারো কমিউনিটির সঙ্গে ওঠাবসা ছিল কম। স্কুলে রাজের সহপাঠিরা বাঙালি হওয়ায় মান্দি ভাষা চর্চার সুযোগ ছিল না। কচি মনে মাতৃভাষার পরিবর্তে বাংলা দাগ কাটে। এমতাবস্থায় নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি করানোর জন্য রাজকে দেড় বছর আগে নিজ গ্রাম টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ধরাটি সাধু মরিয়ম মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে রোমান হরফে পারো ভাষায় পড়ালেখার সুযোগ ঘটে। রাজ এখন স্বচ্ছন্দে নিজ ভাষায় জোড়বেজোড় সংখ্যার নিখুঁত বর্ণনা, হাসিমুখে রসালো ছড়া আওড়ানো এবং মিষ্টি কণ্ঠে পাখি, পাহাড় আর বহমান নদীর সুরেলা গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। মধুপুর বনাঞ্চলের গারো শিশুদের মাতৃভাষা শেখার লড়াই নিয়ে কথা বলার সময় এই তথ্য দিলেন মিশন স্কুলের শিক্ষিকা নিজা দানবৎ। জানা যায়, মধুপুর বনাঞ্চলে গারোদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। বনাঞ্চল হ্রাস এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুন গারোদের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বন বিভাগের সঙ্গে ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ ছাড়াও ঘরেবাইরে বাংলার দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে মান্দি ভাষা ও সংস্কৃতি। আর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে গারো শিশুদের ওপর। মধুপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, বনাঞ্চলের ১৪৪ গ্রামের সরকারি ও মিশনারি স্কুলে বাঙালি শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করে সাড়ে ৩ হাজার গারো শিশু। যেসব গ্রামে হাতেগোনা গারোর বসবাস সেখানে স্কুল বা সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে গারো শিশুরা নিজ ভাষা ছেড়ে বাংলাকে গ্রহণ করছে। মান্দি ভাষায় লিখিত বর্ণমালা না থাকায় সরকার প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত রোমান হরফে মান্দি ভাষায় পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। স্কুল শিক্ষক লুইস নকরেক জানান, দিন দিন যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে অনেকে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। শহরের অনাত্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশুরাও মান্দিভাষা বিমুখ হচ্ছে। নিজ জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি, অনুষ্ঠানাদি, ভাবনাচিন্তা, ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালি থেকে যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা পৃথক – সেই বিভক্তির বহুমুখী মাত্রার রেখাটা অনুভব করতে পারছে না। দৈহিক অবয়বে মোঙ্গলীয় ধাঁচের হলেও চলনে বলনে, মননে বাঙালি বা শংকর জাতিগোষ্ঠীর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। গারো শিক্ষক ডিপক ম জানান, কর্মজীবী অনেক গারো পরিবার এখন মান্দি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাজ নকরেকের মতো অনেক শিশুকে গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করাচ্ছেন। মান্দি ভাষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রপ্ত করাচ্ছেন। জলছত্র কর্পোস বৃষ্টি মিশনের শিক্ষা কর্মকর্তা জিনেস রিছিল জানান, একযুগ আগে কারিতাস ও অক্সফাম প্রথম মান্দি ভাষায় সীমিত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। সরকার কয়েক বছর যাবৎ মান্দি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করায় শিক্ষাকার্যক্রম কিছুটা গতি এসেছে। গারো নারী উদ্যোক্তা মুনমুন নকরেক জানান, পরিবার থেকে শিশু প্রথম ভাষা শেখে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাকে সমৃদ্ধ করে। মান্দি ভাষার প্রতি গারোরা অনেকটা উদাসীন হওয়ায় একটি বৈচিত্র্যময় ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, নয়তো বিকৃত হচ্ছে। আচিকমিচিক সোসাইটির সভানেত্রী সুলেখা মং জানান, মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বিধায় গারো নারীরা দুঃসময়ে যেমন সংসারের হাল ধরেন, তেমনি শিশুদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মান্দি ভাষায় শিক্ষাদীক্ষা নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। মধুপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম খান জানান, সরকার যে কয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে নিজ ভাষায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক বিতরণের ব্যবস্থা করেছে, গারোরা তাদের অন্যতম। গারোদের শিক্ষার হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এবার নিজ ভাষায় শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে তারা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।