কখনো কি শুনেছেন, নদীর জলে আগুন জ্বলে? হয়তো জলে কখনোই আগুন জ্বলে না। তবে জলের ওপর যাদের স্থায়ী বসবাস, তাদের জীবনটা যেন জ্বলন্ত আগুনেরই উদাহরণ। নৌকাতেই জন্ম, অতঃপর জলের ওপর শৈশব, কৈশোর, বিয়ে, সংসার আর মৃত্যু। যেন মাটির দুনিয়ার স্পর্শ পাওয়ার অধিকারহীন জীবনব্যবস্থা। এমনই জীবন মান্তা সম্প্রদায়ের। তবে, সম্প্রতি চরমোন্তাজের কিছু মান্তাদের জীবন বদলেছে। থাকার ঘর- বিদ্যুৎ সবই হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্করা ভোটার হয়েছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছেন। মাটির স্পর্শে বদলে গেছে চরমোন্তাজের সেসব মান্তাদের জীবন। তাইতো কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সরকারের প্রতি।
ভাসমান নৌকায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা’। নির্দিষ্ট বাসস্থান, শিশু শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের খোঁজ মেলে না তাদের জীবনে। ঝড় ঝঞ্ঝা যাই আসুক না কেন, মান্তাদের তা পার করতে হয় নৌকাতেই। দেশের নাগরিক হয়েও জন্মের পর থেকেই মৌলিক অধিকারহীন জীবন কাটে তাদের। এ যেন প্রতিনিয়ত ঠিকানাহীন গন্তব্যে ভেসে চলা। এমনই জীবন মান্তাদের। উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলার বিভিন্ন নদীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই মান্তা সম্প্রদায়।
পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজে ছিল তেমনই বেশকিছু মান্তাদের বাস। বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় ভাসমান নৌকায় বসবাস করছিলেন তারা। নৌকাই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, আর নদীর মাছই যাদের জীবিকার একমাত্র পন্থা। পৃথিবীতে জন্ম নিয়েও তারা কোনোদিন মাটির অংশীদারত্ব পায়নি। যেন তারা মানুষ না। তারা যেন নদীর জলে ভেসে থাকা এক টুকরো শ্যাওলা।
স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের কল্যাণে এমন জলে ভাসা মানুষের জীবনের গল্পগুলো ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে। তখন তিনি, রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে উদ্যোগী হন। মান্তা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে মাটির স্পর্শ এনে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
যেই কথা, সেই কাজ। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় উদ্যোগী হয় রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসনও। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ২৯টি মান্তা পরিবারকে একটি করে ঘর উপহার দেওয়া হয়। চরমোন্তাজ বাজার সংলগ্ন নদীর পাশের খাসজমিতে নির্মিত হয় সেসব ঘর। শুধুই ঘর নয়, সেসব ঘরে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রচণ্ড গরমের দুপুরে সেসব ঘরে আজ বৈদ্যুতিক পাখা চলে। রাতে বাতি জ্বলে। শিশুরা পড়ালেখা করে সেই আলোয়। মোবাইলে চার্য দিতে কোনো দোকান বা ঘরের বাইরে যেতে হয় না। নিজ ঘরেই এখন সব কিছুর ব্যবস্থা হচ্ছে অনায়াসে। এ যেন এক অনন্য প্রশান্তি।
এসব ঘর যেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে মান্তাদের। দেশের মাটিতে জায়গা পেয়ে এরই মধ্যে বদলে গেছে মান্তা সম্প্রদায়ের জীবনধারা। ঘর পাওয়া মান্তারা যেন কূলহীন গন্তব্যের কূল পেয়েছে। হাসি-কান্নার খোরাক পেয়েছে। মৃত্যুর পরে কবরের নিশ্চয়তা পেয়েছে।
দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি ছিল না এসব মান্তাদের। জন্মের পর দশকের পর দশক পেরিয়েছে অনেকের বয়স, তবুও তারা কখনোই ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। বর্তমানে চরমোন্তাজ ইউনিয়নের ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মান্তা পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা। সরবরাহ করা হয়েছে ভোটার আইডি কার্ড। আর এসব পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্ম নিবন্ধন ছিল না। সে সমস্যারও সমাধান হয়েছে।
মান্তা পরিবারের শিশুদের জীবনে শিক্ষা ছিল এক অমাবস্যার চাঁদ। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি ছাড়ানোর স্বপ্ন দেখত না পরিবারের কেউ। মান্তা শিশুদের জন্য গত বছর একটি ভাসমান স্কুল চালু হয়েছে। আর এখন আশ্রয়ণে ঘর পাওয়ার পর শিশুরা স্থানীয় স্কুলগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তাই স্বচ্ছ হচ্ছে এসব শিশদের ভবিষ্যৎ।
ঘরের চালায় তলে রাত কাটানোর সুখ খুঁজে ফিরেছেন মান্তারা। আজ তারা সত্যিই সুখ খুঁজে পেয়েছে। তারা জানে, আজ মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা হয়েছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সন্মান পাওয়ার সুযোগ এসেছে। আর জলে নয়, মাটির বুকে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছে তারা। এ যেন এক স্বপ্ন বোনার দিন, নতুন করে বাঁচতে শেখার দিন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তাদের। তাইতো প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মাটির স্পর্শে ইট-টিনের ২৯টি ঘরে ঠাঁই হওয়া মান্তারা।
এ আশ্রয়ণের একজন বাসিন্দা ফারুক রাঢ়ী। আগে ছিলেন ভাসমান নৌকারই বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘আগে ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হতো। মনে হতো, ওদের জন্ম দিয়ে ভুল করেছি। নিজেদের মতোই ওদের ভাসমান অবস্থায় রেখেই বুঝি মরতে হবে। এখন আর সেই চিন্তা আমাদের ভয় দেখায় না। এখন বাচ্চাদের বাসায় রেখে নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারি, নির্ভয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ, হাসু আপা।
এই আশ্রয়ণে ঘর পেয়েছে রিঞ্জু সরদার। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তার। তিনি বলেন, যখন নৌকায় থাকতাম, তখন নিজেদের মানুষ বলে মনে হইতো না। এখন মনে হয় আমরাও মানুষ। আমরা ঘর পাইছি, বিদ্যুৎ পাইছি, ভোটার হইছি, এর চেয়ে খুশির আর কি আছে? প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, দোয়া করি।’
মান্তা সম্প্রদায়ের নারী সুখি বেগম বলেন, ‘আমার জন্মই হইছে নৌকায়, নৌকায়ই বড় হইছি। জন্মসূত্রেই নৌকায় থাকতাম। এখন নতুন ঘর পাইছি। নতুন ঘর পেয়ে অনেক খুশি আমি। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে পাওয়া এই ঘরটি আমাদেরকে (মান্তাদের) এই দেশের মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রায় নয় লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সরকারি অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন ধাপে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৩টি বাড়ি বিতরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঈদের আগে ৩২ হাজার ৯০৪টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চরমোন্তাজের এই ২৯টি ঘরও।
তবে, এখনো উপকূলীয় একাধিক নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু মান্তা পরিবার। তাদের দিকেও প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মহলের নজর আশা করছে সেই পরিবারগুলো। তারাও চায় ঐ ২৯টি পরিবারের মতোই তাদের জীবনে সুখ আসুক, ভোটদানের অধিকার আসুক, ঘরে বিদ্যুতের বাতি জ্বলুক, ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ুক। তারা স্বপ্ন বুনছে, হয়তো একদিন তাদের দিকেও রাষ্ট্রের নজর পড়বে। আজও যারা ভূমিহীন- ঘরহীন, তারাও আশ্রয় পাবে। হয়তো তাদেরকেও নাগরিক হিসেবে পূর্ণ সন্মান দেওয়ার নির্দেশনা দেবে প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই হয়তো দুঃখ ঘুচবে সব মান্তাদের।