ভাসমান সবজি উৎপাদন ক্ষেতে (ধাপ) কৃষকদের লাভবান করতে সরকার থেকে দেওয়া প্রশিক্ষণ ও কৃষিপণ্য সঠিকভাবে পাচ্ছেন না চাষিরা। প্রশিক্ষণ বাবদ সাড়ে তিন হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও কৃষক পাচ্ছেন আড়াই হাজার টাকা। আবার প্রশিক্ষণ শেষে দেওয়া কৃষি সরঞ্জাম মানহীন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
যদিও ফি বছরের মতো এ বছরও ধাপে সবজি চারা উৎপাদন করে লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা তাদের। তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে পানিবৃদ্ধি আর করোনাকালীন লকডাউনে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে তাদের।
বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারি, উমারের পাড়, বিশারকান্দী, উদয়কাঠি এলাকা ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেল। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, চাষিদের লাভবান করাতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে প্রশিক্ষণের টাকা সঠিকভাবে না পাওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে কিছু জানা নেই।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, চলতি মৌসুমে প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে ধাপ চাষ হয়েছে। এ বছর সরাসরি ধাপ চাষে জড়িত রয়েছে এক হাজারেরও অধিক পরিবার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধাপ চাষ হয়ে থাকে জেলার নিম্নভূমি বানারীপাড়া উপজেলায়। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবিধৌত এ উপজেলার বাইশারি, উমারের পাড়, বিশারকান্দী, উদয়কাঠি এলাকায় বছরের প্রায় আট মাস ধরে ধাপ চাষ হয়।
এর মধ্যে বীজ থেকে চারা উৎপাদন, সবজি উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা। কৃষকদের ধাপ চাষে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে ধাপচাষিদের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দেওয়া হয়ে থাকে। পর্যায়ক্রমে সব চাষিকেই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম চলমান।
উমারের পাড়ের ধাপচাষি কাঞ্চন হাওলাদার বলেন, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ধাপ চাষে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি কিছু সরঞ্জামও দিয়ে থাকে। তবে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়, সেই টাকা আমরা পাচ্ছি না। আবার যেসব সরঞ্জাম দিয়ে থাকে, তাও নিম্নমানের।
এই কৃষক অভিযোগ করে বলেন, অনেকেই আছেন যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে সঠিক টাকা পান না। এ বিষয়ে আমিও কোনো কথা বলতে চাই না। কারণ যে চাষি প্রশিক্ষণের টাকা না পাওয়ার কথা বলবে, দেখা যাবে আগামী বছর প্রশিক্ষণের তালিকা থেকে তার নাম বাদ হয়ে যাবে।
বিশারকান্দি ইউনিয়নের মো. ছালাম বলেন, এ বছর করোনার কারণে অনেক কৃষক সঠিক সময়ে উৎপাদিত চারা বিক্রি করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই অঞ্চলের সবাই কৃষক। কিন্তু তাদের জন্য যে অনুদান বরাদ্দ আসে, তা কৃষকরা পান না। কৃষক পরিচয়ে অনেকে আছেন যারা কৃষক না তারা অনুদান নিয়ে যান।
ফলে কৃষকের জন্য সরকার অনুদান দিলেও কোনো লাভ হয় না। তবে সারা বছর ধাপ চাষ করার সুযোগ থাকায় যে খরচ হয়, তা সারা বছরে তোলা সম্ভব হয়। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে খরচ উঠবে না বলে আশঙ্কা তার।
আরেক কৃষক মো. শাহীন বলেন, আবহাওয়া খারাপ এবং বিভিন্ন স্থানে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর আমরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না। ধাপের চারা এমন একটি জিনিস, যা অতিরিক্ত পানিতে রোপণ করলে তা বাঁচবে না। যেহেতু এ বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা হয়ে পানি বেড়েছে, এ জন্য ক্রেতা নেই। তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণে আমরা সঠিক টাকা পাই না। অনেকের কাছে শুনেছি প্রশিক্ষণ যারা নেন, তাদের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু আমরা পাই আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়া ঝুড়ি, বালতি, নিড়ানি দেয়।
চলতি বছর চাষ করে লাভের মুখ দেখবেন না, এমন আশঙ্কা করে কৃষক শাহীন বলেন, এ বছর দেড় লাখ টাকা মুনাফা খাটালেও এখনো মুনাফাই ওঠেনি। চারার মৌসুম শেষ। লাভ হবে কি না তা নিয়ে শংসয় আছে।
চারা কিনতে আসা আলিম ব্যাপারী বলেন, বানারীপাড়ার ধাপ চাষে উৎপাদিত চারা দেশের সব অঞ্চলে যায়। বিশেষ করে, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মোরেলগঞ্জ, ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সব এলাকায় এখানকার চারা যায়। দেশীয় প্রজাতির সবজির চারা এখানে রোপণ করা হয়। ফলে দেশব্যাপী এই চারার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
আরেক বেপারী সজীব বলেন, ধাপচাষিদের বাজারে যেতে হয় না, পাইকার ব্যবসায়ীরা ট্রলার বা নৌকা নিয়ে ধাপে ধাপে এসে চারা দেখে নিয়ে যায়। ধাপ থেকে তোলার পর তিন দিন পর্যন্ত ভালো থাকে চারা। এর বেশি সময় হয়ে গেলে সেই চারা লাগালে তা আর বাঁচে না।
বাজারদর ভালো না থাকায় এবং পানি না কমায় চারা কিনছেন না আরেক পাইকার শহিদ। তিনি বলেন, এ বছর চারার চাহিদা অনেক কম। অন্যান্য বছর এমন সময়ে ধাপের চারা প্রায় খালি হয়ে যেত। কিন্তু এ বছর পানি না কমে আসায় ক্রেতারা কোথায় লাগাবে সেই জমি পাচ্ছে না। ফলে চারার চাহিদাও কম। ধাপে সব ধরনের সবজির চারা উৎপাদিত হয়। লাউ, কমুড়া, টমেটো, পুঁইশাক, করোলা, মরিচ, পেঁপেসহ বাজারে যত ধরনের কাঁচা তরকারি আছে, সবই এখান থেকে উৎপাদিত হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায় বলে জানান তিনি।
বিশারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. সেলিম বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাপ হচ্ছে বিশারকান্দিতে। এখানে মাইলের পর মাইল ধাপ চাষ হয়। কিন্তু সরকার থেকে যে অনুদান কৃষকদের জন্য আসে, তাতে কৃষকের কিছুই হয় না। কৃষকের পর্যাপ্ত অনুদান দেওয়া উচিত। বরাদ্দে যত অনুদান আসে, তা যেন সঠিকভাবে একজন কৃষক পান, সে বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।
কৃষি সম্প্রদারণ অধিদফতর খামারবাড়ি বরিশালের উপপরিচালক হৃদয়েম্বর দত্ত বলেন, ধাপচাষিদের জন্য আমরা বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি এবং তাদের কৃষিকাজ করতে যেন সহজ হয়, সে জন্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়। কিন্তু যা বরাদ্দ তা না পাওয়ার তথ্য আমার জানা নেই। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ধাপচাষিরা যেন চাষ করে আরও লাভবান হতে পারেন, সে জন্য কৃষি অধিদফতর কাজ করছে