বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি উখিয়া-টেকনাফে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ জেলায় চার দফায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্ত ঘেঁষা নাফনদের ওপারের (মিয়ানমারে) সেনাবাহিনীর ববর্রতায় যখন বিপন্ন সেখানকার রোহিঙ্গা জীবন, ঠিক তখনই তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে অন্য এক মানবিক বাংলাদেশ।
রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থী স্্েরাত আসা শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে। তাতে সাত লাখ ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গাকে মানবিক চিন্তায় আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। এখন নতুন-পুরানো মিলে ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গার ভারে পৃষ্ট হয়ে পরেছে বাংলাদেশ! আজ ২০ জুন- বিশ্ব শরণার্থী দিবস। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হবে।
এদিকে, বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে উখিয়ার-টেকনাফের কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন আয়োজন হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা মাজুমা ও কাদেরসহ জব্বারসহ আরো অনেকের দাবি তাদের সুষ্ঠু প্রর্ত্যাবাসনের। টেকনাফ নয়া পাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের রাবিয়া উৎকণ্ঠায় বলেন,না’ না অভাইয়ান আর ফিরতে চাইনা আমরা। ওরা যতই চুক্তি করুক ওরা আমাদের নির্যাতন করবেই। মরলে আমরা বাংলাদেশেই মরতে চাই। এখানে তো অন্ততঃ দুই বেলা খাবার খেয়ে শান্তিতে থাকতে পারছি”।
প্রচন্ড সংশয় আর উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠে অকপটে কথাগুলো বললেন টেকনাফ নয়া পাড়া শরনার্থী ক্যাম্পে থাকা এক রোহিঙ্গা রাবিয়া খাতুন। বেঁচে থাকাটা যেখানে দুঃস্বপ্ন মাত্র, মাতৃভূমির বায়ু যেখানে মৃত্যুর কড়া নাড়ে; স্বদেশের আলো যেখানে শরীর ঝলসায় আর প্রিয় জন্মভূমির মাটি যখন পরিনত হয় মৃত্যু কূপে তখন এমন হাজারো রাবিয়া খাতুনের কণ্ঠে উৎকণ্ঠার বাক্য হৃদয় বিদারক হয়ে ফুটে উঠে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী হলেও দেশটির সরকার তাদের বৈধ নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করায় মুসলমান এই জনগোষ্ঠি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে। তবে ভাষা ও সংস্কৃতির মিল থাকায় এরা খুব সহজেই এসে পড়ছে বাংলাদেশে। আশ্রয় নিচ্ছে সীমান্ত শহর কক্সবাজার ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের আশপাশের এলাকায়। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে চলছে রোহিঙ্গাদের এদেশে আসার প্রক্রিয়া। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন ,বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফ দুটি উপজেলায় ১০ লাখের মত রোহিঙ্গা রয়েছে। শরণার্থী দিবসটি উদযাপন করতে রোহিঙ্গা শিবিরে বেশ কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে,কক্সবাজারের কুতুপাংয়ের পাহাড়ের চূড়ায় দাড়াঁলে দেখা মিলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি। সব মিলে উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়, বন ও জঙ্গল কেটে ৩৪টি শরাণার্থী শিবিরে আশ্রয়স্থল গড়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা। তবে এসব শিবির দেখে বুঝা খুবিই মুশকিল আসলে রোহিঙ্গা শরাণার্থী শিবিরের সংখ্যা কত? বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন যেন উখিয়া ও টেকনাফের সর্বত্র শরণার্থী শিবির। এ দুই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা চার লাখ ৭১ হাজার ৭৬৮।
টেকনাফ শহর থেকে প্রাায় দশ কিলোমিটার উত্তরে উখিয়া-টেকনাফ সড়কের পশ্চিমে লেদা পাহাড়ে ঢালে ২৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই আশ্রয় কেন্দ্র। এখানকার পুরোনো বাসিন্দারা প্রায় সবাই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন ২০১২ সালে। তবে দিন যতই গড়াচ্ছে, রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে অস্থিরতা। একই সঙ্গে বাড়ছে হত্যা, গুম, অপহরনসহ নানা অপরাধ। এইভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে গুটা এশিয়াতে অস্তিরতা বাড়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
লেদা আশ্রয় কেন্দ্রের সরু গলির দু-পাশে লম্বা করে একেকটি ঘর। বাঁশের বোড়ার ওপরে ত্রিপল বা লবণ খেতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সিটের ছাউনি। এর ভেতরে বেড়া দিয়ে ১৫ হাত লম্বা ১৫ হাত চওড়া একেকটি ঘর বাসিন্দাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অর্থায়নে আশ্রয় কেন্দ্রের এই অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রের পরিবেশ অত্যন্ত ঘিঞ্জি হলেও এখানে সুপেয় পানি আর স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে। এই দুই সুবিধার কারণেই এখানকার বাসিন্দারা সন্তুষ্ট। রবি আলমের ঘরটি ডি-ব্লকে। তার নিজেরই পরিবারের লোকসংখ্যা ৮ জন। তার ওপরে নতুন এসে উঠেছেন ১০ জন। তিনি বলেন খুব, কষ্ট করে আছেন। কিন্তু এক সময় তাঁরাও বাংলাদেশে এসে এভাবেই পরিচিতদের ঠিকানায় উঠেছিলেন। সেসব কথা বিবেচনা করে সমায়িক এই কষ্ট মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে নতুনদের উখিয়া পাঠানো হয়েছে। এইভাবে আর শরণার্থী জীবন পার করতে চায় না। নিজ দেশে ফেরত যেতে চায়, তবে নাগরিক অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে।
মোহাম্মদ সৈয়দ আলম সাগরে মাছ ধরেন। এখন তাঁর বয়স ২৬ বছর, এখানে যখন আসেন তখন বয়স ছিল ১১ বছর। বাবা নেই। মংডুতে সেনাবাহিনী তার বাবাকে খুন করেছিল। উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের বি-বক্লের বাসিন্দা। তিনি বলেন, বিয়ে করেছেন, দুটি ছেলে আছে। তাঁর শাশুড়ি আর স্ত্রী দুজনেই টেকনাফ শহরে হোটেলে রান্নার কাজ করেন। এইভাবে চলছে তাদের জীবন। আলম আরও বলেন, বাংলাদেশ আমাদের বাড়ি নয়, চিরদিন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে থাকতে চাই না।” আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই; তবে নাগরিক অধিকার, ধন-সম্পদসহ সবকিছু দিতে হবে। এভাবে আর বাস্তুহারা হিসেবে থাকতে চাই না।’
সংশ্নিষ্টদের ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। সেবার বাংলাদেশে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আড়াই লাখ শরণার্থী মিয়ানমার পরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আসে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৭ জন শরণার্থী। এর মধ্যে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে। ফলে প্রতিবারই কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে গেছে। তবে ১৯৯২ সালের পর আরও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গারা এলেও তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আর দেখা যায়নি। এরপর প্রত্যাবাসন বন্ধ হয়।
এরপর ২০১২ সালের ৩ জুন মিয়ানমারে তাবলিগ জামাতের ওপর হামলা চালায় রাখাইনরা। সে সময় সংর্ঘষ শুরু হয়। সংঘর্ষ মংডু থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ওই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে পালানো শুরু করে রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে পুলিশের ছাউনিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য হতাহত হয়। তখন মিয়ানমার সরকার দাবি করে, এ হামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত। পরদিন রাতে হঠাৎ মিয়ানমারের সেনারা সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ঘিরে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করে। ওই সময় ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪টি সীমান্ত চৌকিতে একযোগে হামলা হয়। আবারও শুরু সেদেশে হয় অপরাধী দমনের নামে অভিযান। পরের দিন ২৫ আগস্ট থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। তাতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফে। হ্নীলা ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মুহাম্মদ আলী বলেন,রোহিঙ্গা সমস্যা কোন দিন সমাধান হবেনা। নাফনদী সীমান্ত অরক্ষিত রয়ছে। যত দিন সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া না হবে ততদিন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবেনা ফের সম্প্রীতি সময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতেছে। গত (১২ জুন) শনিবার থেকে নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ৬ জন লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে কিছু অসাধু দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অনুুপ্রবে করতেছে। আমি মনে করি সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নজরদারি দিতে হবে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন,রোহিঙ্গা শিবির গুলো পাহাড়ের তীরে হওয়ায়, বিশাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ প্রতিদিনই বাড়ছে। তবু রোহিঙ্গা শিবিরে বিশৃঙ্খলা ঠোকাতে রাত-দিন দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষ রোহিঙ্গাদের কারনে ঝুকিতে রয়েছে। মিয়ানমারের মিথ্যাচারের কারনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে, এতে দেশ ঝুকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে। তবে রোহিঙ্গার তৎপরতা নানা সামাজিক সংকট তৈরি করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’