বাংলাদেশের শহীদ দিবস (২১ শে ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার ২১ বছরেও বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’ যুক্ত হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৯টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এসব বিমানবন্দরে ওয়েলকাম সেন্টার বিশ্বের প্রায় ১শ ভাষায় ইংরেজি ‘ওয়েলকাম’ শব্দের অনুবাদ প্রদর্শিত হলেও শুধু যুক্ত করা হয়নি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ‘স্বাগতম’। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রতি মার্কিনীদের যেমন অবজ্ঞা তেমনি বিশ্বে সকল বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য লজ্জাও বটে।
বিশ্ববাসীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ও সুপরিচিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি (জেএফকে) এবং সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টার হার্টসফিল্ড-জ্যাকসনে ঘুরে দেখা গেছে সেখানে ওয়েলকাম সেন্টারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাংলায় লেখা নেই ‘স্বাগতম’।
শুধু নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি (জেএফকে) কিংবা আটলান্টার হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন বিমানবন্দরই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৯টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ২১ বছরেও ওয়েলকাম সেন্টারে বাংলায় ‘স্বাগতম’ না লেখায় চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’র মর্যাদা। বিশ্বের ১শ ভাষায় ইংরেজি ‘ওয়েলকাম’ শব্দের অনুবাদ প্রদর্শিত হয়েছে। কোন কোন ভাষায় ‘ওয়েলকাম’ শব্দের অনুবাদ একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিমানবন্দরের সংখ্যা ১৯ হাজার ৭শ’র বেশি। এর মধ্যে ৫ হাজার ১৭০টি সাধারন জনগণের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। এছাড়াও ৫০৩টি বিমানবন্দর রয়েছে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক বিমান উঠানামার জন্য।
নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি (জেএফকে), লাগার্ডিয়া, নিউ জার্সির নিআর্ক লিবার্টি, বোস্টনের লোগান, ইলিনয়সের শিকাগো ও’হারে, ওয়াশিংটনের সিয়াটলের টাকোমা, ফ্লোরিডার মায়ামি, ফোর্ট লটারডেল, মিনিয়াপলিস সেন্ট পল, ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি’র ডুলাস, টেনেসির ন্যাশভিল, ক্যানসাসের উচিতা ডিওয়েট ডি অ্যাসেনহোয়ার, আটলান্টার হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন বিমানবন্দর ঘুরে এ প্রতিনিধি কোথাও ওয়েলকাম সেন্টারে খুঁজে পাননি বাংলা লেখা স্বাগতম।
এ ব্যাপারে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হলে নিআর্ক লিবার্টি বিমানবন্দরের ওয়েলকাম সেন্টারের সুপারভাইজার প্যাগি বলেন, বিভিন্ন ভাষায় লেখাযুক্ত নতুন ওয়েলকাম বোর্ডটি গত সাত বছর আগে বিভিন্ন বিমানবন্দরে লটকানো হয়েছে।
নতুন বোর্ডে বাংলায় স্বাগতম (ইংরেজি ওয়েলকাম) লেখা নেই কেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্যাগি বলেন, শুধু বেঙ্গলি না, অনেক ভাষাই এখানে বাদ পড়েছে। এর কারণ এত বড় জায়গা সেখানে নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাংলায় ‘স্বাগতম’ লেখা নেই কেন এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। বাংলা ভাষা ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বলা হলে প্যাগি বলেন, তিনি এ বিষয়টি জানেন না। এ ব্যাপারে বিমানবন্দর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন প্যাগি।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে অমর একুশের অবস্থান অনন্য। অমর একুশে এখন সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। মহান একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন ও অকুতোভয় নেতৃত্বে আন্দোলন করে এগিয়ে গেছে। এই চেতনার পথ ধরে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের শহীদ দিবস (২১ শে ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ অনেকেই। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। একই বছর মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে যখন ইউনেসকোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলন বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে। আমাদের ভাষা শহীদদের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার্থে এই দিনে নতুন করে অঙ্গীকার করেন। সারা দেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এ অর্জন বাঙালি জাতির জন্য বিরাট গৌরবের বিষয়। বহু দেনদরবার ও কূটনৈতিক কলাকৌশল খাটিয়ে এই সফলতা অর্জন করেছেন বাঙালি জাতি। মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভাষা এবং প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
ভাষার বৈচিত্র্য ও বহুভাষিক চর্চায় আরও সচেতনতার জন্য ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রদান করেন। দিনটি বিশ্বব্যাপী অনেকে দেশেই বার্ষিক ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
২০১২, ২০১৬ ও ২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ব্যালট পেপারে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষারও দেখা মিলেছে। নিউ ইয়র্কের বোর্ড অব ইলেকশনে সম্পৃক্ত একজন বাংলাদেশি জানান, নির্বাচনের দিন ভোটারদের হাতে যে ব্যালট পেপার দেওয়া হয়েছে তাতে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টসহ প্রার্থীদের নাম ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দেখা গেছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষাও ছিল।
ভোটের দিন কিছু কিছু কেন্দ্রে বাংলা দোভাষীর এবং সব কয়টি কেন্দ্রের বাইরে অন্যান্য ভাষার মতো বাংলায়ও দিক নির্দেশনা লেখা ছিল। নিউ ইয়র্কের কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, নিউ জার্সির প্যাটারসন, আটলান্টিক সিটি, ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস, পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার অনেক কেন্দ্রে বাংলাদেশি পোলিং অফিসারও ছিলেন গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। মার্কিন কংগ্রেসে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রেস মেং দিনটির তাৎপর্য সবার সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে গত কয়েকবছর আগেই নতুন বিল উত্থাপন করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে জাতীয়ভাবে পালনের জন্য ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একটি বিল তুলেছেন মার্কিন কংগ্রেসে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রেস মেং। তিনি বলেন, বিলটি পাসের জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন এবং অচিরেই বিলটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলা ভাষার বিস্তার এখন সারা বিশ্বে বলে উল্লেখ করেন গ্রেস মেং। ইউনেস্কোর ঘোষণায় বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস হিসেবে পালনের জন্য কংগ্রেসে বিলটি উত্থাপন করেছেন তিনি।
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ২০১৬ সালেও একই বিল উত্থাপন করেছিলেন মার্কিন কংগ্রেসে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রেস মেং। এই বিলটি ভোটে যাওয়ার আগে প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির অনুমোদনের প্রয়োজন জরুরি ছিল। কংগ্রেসে মেং নিউ ইয়র্কের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার নির্বাচনী এলাকায় বহু বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ রয়েছে। এর আগেও তিনি কংগ্রেসে দু’বার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে বিল উত্থাপন করেছেন, তবে তা পাস হয়নি। কংগ্রেস সদস্য জোসেফ ক্রাউলিও একই রকম বিল উত্থাপন করেছেন কংগ্রেসে।
বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে ব্যাপারটা বেশ ব্যয়বহুল। কাজেই ভেবেচিন্তে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বাংলা ‘স্বাগতম’ যুক্ত করার ব্যাপারে ২১ বছরেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেলরা। শুধু তাই নয় যুক্তরাষ্ট্র দুই শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন থাকলেও কেউ কোন উদ্যোগই গ্রহন করেননি।
একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বাংলা ‘স্বাগতম’ যুক্ত করা হলো কিনা, এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেলদের চিন্তা করার কারো সময় নেই। আর যারা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মাথায় এ চিন্তা আদৌ আসে নাই।