প্রায় ১৬০ বছর পুরনো উলানিয়া মসজিদ বরিশালের অন্যতম অনন্য স্থাপনা। ১৮৬১ সালে বর্তমান বরিশাল জেলার (তৎকালীন বাখরগঞ্জ জেলা) মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে মসজিদটি নির্মিত হয়। নির্মাণের আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণে এই মসজিদটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের মে মাসে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। সংস্কার শেষে মসজিদটি পর্যটকসহ সবার প্রশংসা লাভ করে। পঞ্চদশ সালের গোড়ার দিকে এই অঞ্চল ছিল মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণে পর্যুদস্ত। এই মগ হার্মাদদের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ। তাদের দমনের উদ্দেশ্যে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবেদার শায়েস্তা খানকে পাঠান। শায়েস্তা খান তার ছেলে উমেদ খান ও বিশাল রণতরী, সৈন্য ও গোলাবারুদ নিয়ে জলদস্যুদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুরে কেল্লা তৈরি করা হয়। স্থানীয়ভাবে যা সংগ্রাম কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। এই অভিযানে মো: হানিফ নেতৃত্ব দিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মগ-পর্তুগিজ- হার্মাদরা বিতাড়িত হয়। কিন্তু পারস্য বংশো™ভূত হানিফ খান এদেশে ভালোবেসে থেকে যান। হানিফের ভ্রাতৃপুত্র ও জামাতা এবং উত্তরাধিকারী শেখ মো: হাবিজ পরবর্তীকালে সংগ্রাম কেল্লা থেকে সামান্য পশ্চিমে উলানিয়া অঞ্চলে এসে বসবাস করেন। মো: হাবিজের পুত্র শেখ মো: সদরুদ্দিনের আমলেই মূলত উলানিয়ায় জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার তিন পুত্র ছিল এরা হলো নয়া রাজা চৌধুরী, কালা রাজা চৌধুরী ও হাসান রাজা চৌধুরী। এদের সময়েই বসত বাড়িটিকে উঁচু প্রাচীর ঘেরা দুর্গের মতো করে নির্মাণ করা হয়। এরপর বাড়ির প্রধান ফটকের পাশেই নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ। এটিই বরিশালের উলানিয়া জামে মসজিদ নামে পরিচিত। ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠার পর মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার করা হলেও মূল অবয়ব এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি অনেকটা তাজমহল আকৃতির। মসজিদের সামনে বাঁধানো চওড়া পুকুর রয়েছে। মূল গৃহের আগে লোহার ছয় খামের ওপর প্রতিষ্ঠিত জাফরির কাজ রয়েছে। এখানে বিমের ছাদ রয়েছে। মসজিদের তিনটি দরজা। ভেতরে একসাথে শতাধিক মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের আর একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্যান্য মসজিদের থেকে আলাদা। সেটি হলো মসজিদ গাত্রে শিলালিপি। এই মসজিদ গাত্রের পুরনো শিলালিপিটি এখন আর নেই। তবে এই রকম শিলালিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। মসজিদের বাইরের গাত্রে চীনা মাটির টুকরো দিয়ে গড়া রয়েছে। এটি মূলত মোগলরীতিতে তৈরি। ভেতর ও বাইরের গাত্রে জ্যামিতিক লতাপাতা ও ফলের নকশা রয়েছে। মসজিদের মূল নামাজ ঘরে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। তিনটি দরজার মধ্যে মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং এটির দুই পাশের দুই দেয়ালের নকশার নিচে উৎকীর্ণ শিলালিপি ছিল। ডান দিকের দেয়ালে উৎকীর্ণ কুরআন শরীফের আয়াত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেশির ভাগ লেখা টিকে আছে। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল মসজিদ প্রতিষ্ঠাবিষয়ক বক্তব্য। ১৯৯৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটিকে সংরক্ষণযোগ্য ঘোষণা করেন। জমিদারির পক্ষের আপনজনরা কিছু সংস্কার করে। ২০০৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার হারুন অর রশিদ মসজিদ সংস্কারে ভূমিকা রাখেন। অতঃপর কুয়েত ভিক্তিক মসজিদে সাহায্য দানকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ার মো: এস কিওয়ান মসজিদটি সংস্কারের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে মসজিদের ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। সংস্কার শেষে মসজিদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সৌন্দর্য বহুগুণে বর্ধিত হয়। বর্তমানে মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক আসেন।