দেশের অন্যতম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে অত্যাধুনিক সরঞ্জামসহ হাসপাতাল থাকলেও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দ্বীপবাসী। দ্বীপের পশ্চিম-মাঝার পাড়ায় ১০ শয্যার হাসপাতালটি ২৫ বছর ধরে এক রকম অচল পড়ে রয়েছে। লোকবলের অভাবে স্থানীয়রা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। তবে কেবল ভিআইপি কোনও ব্যক্তি ভ্রমণে এলে চিকিৎসকদের দেখা মেলে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় দ্বীপে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। গত আগস্ট মাসে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় দ্বীপের বাসিন্দা স্কুলছাত্র নাসিম উদ্দিন, চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) মো. রুবেলসহ এক কিশোরী প্রাণ হারায় বলে দাবি তাদের পরিবারের। মৃত স্কুলছাত্র নাসিম উদ্দিনের বড় ভাই মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘ছোট ভাইকে সকালে সৈকত থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সে সময় তার শ্বাস চলছিল। তবে হাসপাতাল বন্ধ থাকার কারণে তাকে কোস্টগার্ডের জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারা জানিয়েছিল, যদি আধাঘণ্টা আগে চিকিৎসা পেতো তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেতো। দ্বীপে আরও অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। এখানে চিকিৎসা সুবিধা থাকলে হয়তো তারা মরতো না।’ স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সেন্টমার্টিনে বিপুলসংখ্যক পর্যটক এবং স্থানীয় প্রায় ৯ হাজার বাসিন্দার কথা চিন্তা করে সরকার ১৯৯৫ সালে অত্যাধুনিক ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করে। হাসপাতালে রয়েছে একটি অপারেশন থিয়েটার। চিকিৎসা সুবিধার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। এ হাসপাতালে দুই জন চিকিৎসক, একজন মেডিক্যাল অ্যাসিস্টেন্ট, একজন ফার্মাসিস্ট, তিনজন সহকারী নার্স, দু’জন ওয়ার্ড বয়, একজন আয়া, একজন এমএলএসএস ও একজন নৈশপ্রহরীসহ ১৩ জনের নিয়োগ বরাদ্দ রয়েছে। দ্বীপবাসীর অভিযোগ, সর্বশেষ গত বছর ডিসেম্বরে হাসপাতালে দু’জন চিকিৎসকের পোস্টিং হলেও একদিনও আসেননি তারা। বাস্তবে মাত্র একজন চিকিৎিসক ও একজন এমএলএসএসের নিয়োগ আছে। নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক ও কর্মচারীকেও আবার সেখানে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, সর্বশেষ গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতে আহনাফ চৌধুরী ও রুমানা রশিদ নামে দুই চিকিৎসককে সেন্টমার্টিন হাসপাতালে পোস্টিং দেওয়া হয়। তবে তারা সেখানে যোগদান করেননি। বর্তমানে রুমানা রশিদকে সাময়িকভাবে অন্য জায়গায় বদলি করা হয়েছে। এর আগে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর আহনাফ চৌধুরী এখনও টেকনাফ হাসপাতালে কাজ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় চিকিৎসকদের পোস্টিং দেওয়া হলেও চিকিৎসকরা দ্বীপে থাকতে চান না। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় বিভিন্ন ট্রেনিং, উচ্চশিক্ষা কিংবা অন্য কোনও অজুহাতে পছন্দের জায়গায় পোস্টিং অথবা উপজেলায় থেকে যান চিকিৎসকরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, দ্বীপে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর শুরুতে ৭-৮ মাস স্বাস্থ্যসেবা চালু থাকলেও এরপর থেকে তেমন কোনও চিকিৎসাসেবা পায়নি স্থানীয়রা। এমনকি করোনাকালেও স্থানীয়রা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘দ্বীপে ব্যবসায়ীসহ ৯ হাজারের বেশি মানুষের বাস। তবে সেন্টমার্টিনের হাসপাতালে সব থাকলেও নেই কোনও চিকিৎসাসেবা। বিনা চিকিৎসায় ৫-৬ জন মানুষ মারা গেছেন। যুগ যুগ ধরে এই দ্বীপের মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। তবে দ্বীপে কোনও ভিআইপি ভ্রমণে আসলে ঠিকই চিকিৎসকরা এসে হাজির হন। শুধু কি ভিআইপিদের চিকিৎসাসেবা দরকার’ প্রশ্ন রাখেন তিনি। এদিকে সোমবার দ্বীপে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার টেকনাফ থেকে চিকিৎসকের একটি দল সেন্টমার্টিন হাসপাতালে পৌঁছায়। তবে বিষয়টি অনেকেই জানেন না। কেননা দীর্ঘদিন হাসপাতালটি জনমানব শূন্য ও তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. টিটু চন্দ্র শীল বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচল শুরুর পর থেকে সেখানে চিকিৎসকদের একটি টিম কাজ করছে। কিন্তু তাদের থাকার ঘরে বিদ্যুৎ-পানির দুরবস্থা। বিষয়টি সমাধানে স্থানীয়দের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তার দাবি, ‘অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে চিকিৎসকের অভাব ছিল, তবে এখন থেকে টেকনাফ হাসপাতালের বাইরোটেশনে চিকিৎসকের একটি টিম দ্বীপে দায়িত্ব পালন করবে।’ দ্বীপের কোনও মানুষ যাতে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে বলে জানান তিনি।