বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুল হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১০৮ বছরে পদার্পণ করল। সামনে বিস্তৃত সবুজ মাঠ। পেছনে তাল-সুপারির বনানী। একপাশে জলে টইটুম্বুর দীঘি। অন্যপাশে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া খাল। আর মধ্যখানে মধ্যমণি হয়ে আছে একটি ‘ই’ আকৃতির স্থাপনা। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুল। হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণের বিদ্যাপীঠ। উলানিয়ায় ১৯১২ সালের আগ পর্যন্ত কোনো স্কুল ছিলো না। জমিদার বাড়ির ছেলেরা ঢাকা, কলকাতা ও বরিশাল শহরে লেখাপড়া করত। জমিদারদের ভাবনা ছিল নেতিবাচক। প্রজার সন্তান শিক্ষিত হলে তাদের সম্মান করবে না-এমনটাই ধারণা ছিলো। তবে তাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত করলো এক প্রজার ছেলে। সে ১৯১১ সালের কথা। কলকাতার গড়ের মাঠে সমগ্র বাংলার জমিদারদের বার্ষিক সম্মেলন শুরু হয়। বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্য রাষ্ট্রীয় অতিথিরা মঞ্চে বসা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের সচিব। দর্শকসারিতে শত শত জমিদার বসা। হঠাৎ অনুষ্ঠানের পরিচালক মাইকে ঘোষণা করলেন, আমি বরিশালের উলানিয়ার এক গরিব প্রজার সন্তান। এক মহানুভব জমিদারের সহায়তায় আমি লেখাপড়া করতে পেরেছি। উলানিয়ার সেই জমিদার ইসহাক চৌধুরী দর্শকসারিতে বসা থাকবেন আর আমি মঞ্চে, এমনটা হতে পারে না। তাই আমি ইসহাক চৌধুরীকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো সমাবেশস্থল। বিষয়টি চৌধুরীর মনে দাগ কাটে। তিনি ভাবলেন, যেখানে শত জমিদার দর্শকসারিতে, সেখানে শিক্ষার জোরে এ গরিব প্রজার সন্তান অতিথির আসনে। তাই তিনি উলানিয়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করলেন। যাতে এ এলাকার সন্তানেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে। সম্মেলন থেকে ফিরেই তিনি বিশাল সুপারি বাগান কেটে নির্মাণ করেন একটি শনের ঘর। সেখান থেকেই ১৯১২ সালে উলানিয়া স্কুলের পথচলা শুরু। জমিদার ইসহাক চৌধুরীর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এই স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। তাদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি আসাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. শফিউর রহমান, সাবেক সচিব গোলাম মোস্তফা তালুকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সাংবাদিক মিজান শাজাহান প্রমুখ। উলানিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, প্রচুর উলুবন থাকার কারণে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে উলানিয়া। এখানে প্রচুর নলের আখড়া থাকায় নলের হাবেলী নামেও পরিচিত ছিল। ৩০০ বছর আগে নয়া রাজা চৌধুরী, কালা রাজা চৌধুরী ও হাসান রাজা চৌধুরী এই তিন সহোদর লবণের ব্যবসায়ের জন্য উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতা থেকে উলানিয়ায় পত্রিকা যেতো। সে সময় উলানিয়ার রাস্তায় কেরোসিন জ্বালিত ল্যাম্প পোস্ট ছিলো। এই স্কুলের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশা মেঘনা নদী। ১৫ বছর আগে উলানিয়া স্কুল থেকে মেঘনার দূরত্ব ছিল ছয় কিলোমিটার। এখন তা দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তাহলে কি হারিয়ে যাবে উলানিয়া স্কুল? হারিয়ে যাবে নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরী, মরহুম বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, ভাষাসৈনিক বাহাউদ্দিন চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত উলানিয়া? উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও উলানিয়া মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ১৯১২ সাল থেকে শতাব্দীর এ বাতিঘর জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও উপজেলায় সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছি। এ ধারা অব্যাহত রাখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তা প্রত্যাশা করেন মো. হেলাল উদ্দীন।