ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও শিক্ষানুরাগী মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল শনিবার। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।’ আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেন নি। বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।’ বাউন্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।’ যে কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট মুকুন্দদাস হতে পেরেছিলেন। অশ্বিনী কুমার দত্তের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে। তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাব-জজ ছিলেন।’ আর মা প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার রাধাকিশোর গুহের মেয়ে। বাবার মতো মাও ছিলেন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক।’ ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর পরিবারে ৪ ছেলে ও ২ টি মেয়ের জন্ম হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে।’ পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা তাঁকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সম্পন্ন করতে হয়।’ পিতার কর্মস্থল ঢাকা, ঢাকা থেকে দৌলত খা, রংপুর প্রভৃতি স্থানে পড়াশুনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার যোগ্য হয়ে উঠেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৪ বছর। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে ১৭ বছরের নিচে কেউ পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার পেত না। তাই অশ্বিনী কুমার দত্তের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।’ প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ওই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন।’ ২৩ বছর বয়সে বি এ (১৮৭৮) এবং এক বছর বাদে এম এ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ১৮৭৯ সালে বি এল পরীক্ষা দেন এবং এ পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন।’ ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকটে চাতরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৭৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং একই বছর বিএল পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকট চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।’ অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। ১৮৮০ সালে বরিশালে এসে তিনি ওকালতি পেশা শুরু করেন।’ অশ্বিনীকুমার যখন বিএল পাস করে আইন ব্যবসা শুরু করেন বরিশালে তখন সেইখানে এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছিল।’ বার লাইব্রেরিতে উকিলরা অত্যন্ত কদর্য আর অশ্লীল ভাষায় কথা না বলে আনন্দ পেতেন না। অতিরিক্ত মদ্য পান এবং গনিকালয় এ যাওয়া অনেক কৃতিত্বর মনে করা হতো। সে সময় সার্থক উকিলেরা তাদের প্রিয় গনিকার বাড়িতে বসেই মক্কেলদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। আদর্শবান এবং চরিত্রবান উকিল অশ্বিনীকুমার এই পরিস্থিতি সহ্য করতে পারলেন না। উকিলদের এইসব জঘন্য কার্যকলাপ এর জন্য তিনি নিজে উকিল হয়েও ওইসব উকিলদের বিরুদ্ধে বার লাইব্রেরি, কোর্ট চত্তর ও পথে ঘাটে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন।’ তাঁর আবেদনময় এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বরিশাল শহরের মানুষ শুধু অনুপ্রানিত ও মুগ্ধ হতো না, তারা প্রকাশ্যেই ওই উকিল আর ধনীদের অশ্লীলতা আর কদর্যতার বিপক্ষে মুখর হয়ে উঠলো। তাঁর এই উদ্যোগ এর কারনেই বন্ধ হল উকিলদের এই কদর্যতা।’ অশ্বিনীকুমার শুধুমাত্র উকিলদের সংযত করেই খুশি হলেন না। বরং তিনি পথে-ঘাটে, হাতে-বাজারে, স্টীমার ঘাটে ও মাঝি-গোয়ালা থেকে শুরু করে চাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপকদের সামনেও জীবনে সত্য-প্রেম-পবিত্রতা সম্পর্কে অত্যন্ত আবেগময় কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন এবং আপামর সাধারণ মানুষও প্রভাবিত হতে আরম্ভ করলো। সে সময় বরিশালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নানাদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।’ গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে ছিল সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে। ১৮৮২ সালে অশ্বিনীকুমার ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলসভাবে নানাবিদ কাজ করতে শুরু করেন।’