ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এতে বিভক্তিও বাড়ছে। এরই মধ্যে অনেক স্থানে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনাও। আগামীতে এ ধরনের সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচন এবং তৃণমূল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে হামলা-মামলা অন্যদিকে নেতৃত্বের বিরোধের চেষ্টা করেও সংগঠনকে শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে অনেক নেতাকর্মী দলীয় রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
অভিযোগ উঠেছে কোন্দলের পেছনে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ইন্ধন আছে। ফলে হাইকমান্ড চাইলেও সহজে এ দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারছেন না। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আরও কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী।
তারা মনে করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ এমনকি মনোনয়নের ক্ষেত্রে যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ম্যানেজ করে অযোগ্য ও সুবিধাবাদীরা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নিচ্ছেন। বাগিয়ে নিচ্ছেন মনোনয়নও। এর ফলে দলের দুঃসময়ে যারা পাশে ছিলেন, তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। এ থেকেই বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সংঘাত।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই। এত বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় পদের সংখ্যা কম। তাই কমিটিতে সবাইকে রাখা সম্ভব হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমাদের একজনকেই বেছে নিতে হয়। ফলে অনেকের মধ্যে পদ ও মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে কিছুটা অভিমান থাকতে পারে। সেটাকে আমরা কোন্দল বলছি না। নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো অভিমান বা কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করছি।
জানা গেছে, করোনা শুরুর পর নির্বাচনী কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। করোনার দোহাই দিয়ে দুটি উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে বিএনপি। কিন্তু বাকি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। এর পরই সম্ভাব্য প্রার্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠেন। একাধিক প্রার্থী উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে শুরু হয় গ্রুপিং।
ঢাকা-৫ উপনির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। এ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন নবীউল্লাহ নবী। তিনি এবারও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হন নবী। দলের হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেন। সালাহউদ্দিনের পক্ষে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এমনকি তার সমর্থকদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ভোট কেন্দ্র করে সালাহউদ্দিন ও নবীউল্লাহ নবীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এটা মেটাতে হাইকমান্ড উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসেনি। নির্বাচনী প্রচারে নবী ও তার সমর্থকদের মাঠে দেখা যায়নি। উল্টো কৌশলে নবী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
ঢাকা-৫ উপনির্বাচনে মনোনয়ন ঘিরে দলের সিনিয়র নেতারাও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। সালাহউদ্দিন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের অনুসারী। অন্যদিকে নবী প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। সালাহউদ্দিনকে মনোনয়ন দেয়ায় খোকাপন্থীরাও মাঠে নামেনি। ১৭ অক্টোবর এ আসনের নির্বাচনেও নবী ও তার সমর্থকদের কোনো ভোট কেন্দ্রে দেখা যায়নি।
এদিকে ঢাকা-১৮ উপনির্বাচন ঘিরেও চলছে কোন্দল। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ আসনে এসএম জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেয়ার পর বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। প্রার্র্থী ঘোষণার পরদিন ১০ অক্টোবর উত্তরায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় হামলা চালান মনোনয়নবঞ্চিতরা। ওই ঘটনায় ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু এরপরও থামেনি বিরোধ।
জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল ও গুলশানে হামলাকারীদের বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে বিদ্রোহীরা। জাহাঙ্গীর যেখানে প্রচারে নামবেন সেখানেই হামলা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি কাউন্সিলর প্রার্র্থী আকবর আলী হোসেনের বাসায় প্রস্তুতি সভা চলাকালে জাহাঙ্গীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন জাহাঙ্গীর।
কিন্তু একটি সূত্র জানায়, এ হামলার পেছনে মনোনয়নবঞ্চিতদের একটি অংশের ইন্ধন রয়েছে। উপনির্বাচন নয়, আগামী পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও অনেক স্থানে মুখোমুখি অবস্থানে একাধিক গ্রুপ।
শুধু মনোনয়ন নয়, দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করেও শুরু হয়েছে কোন্দল। ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের জেলা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণার পর প্রকাশ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অনেক জায়গায় কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বঞ্চিতরা। যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
এদিকে বিএনপির জেলা কমিটি পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করেও অনেক স্থানে ফুঁসে উঠছেন নেতাকর্মীরা। কমিটিতে পদ পেতে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, নির্বাচন এবং দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা চাঙ্গাভাব তৈরি হয়েছে। মনোনয়ন এবং কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে একাধিক নেতা তাদের অনুসারীদের নিয়ে শোডাউন করছেন। এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত হবে না। বলতে পারেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় দলে আরও গতি আসছে। কিন্তু এ প্রতিযোগিতা যাতে সংঘর্ষে রূপ না নেয় সেদিকে হাইকমান্ডকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।