‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’ গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা বিখ্যাত এই গানের প্রথম লাইনের মতোই যেন অবস্থা দেশের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর। রাজধানীর ঢাকার বাইরে নেই খুব একটা কর্মী-সমর্থক ও সাংগঠনিক তৎপরতা। রাজনীতিতেও তেমন প্রভাব নেই। দলীয় কার্যালয় বলতে যা আছে, তাও ঢাকায়।
বাবুই পাখির বাসার মতো ছোটখাটো ঘড়ের মধ্যেই যেন কোনোভাবে টিকে থাকা। তবুও নানা সময়েই আলোচনায় উঠে আসে ছোট ছোট এই দলগুলো। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের উত্তাপ এদের আকাশছোঁয়া। আর এই উত্তাপের আগুনে পুড়ে নিজেরাই বারবার খণ্ড-বিখণ্ড হচ্ছে। ভাঙাগড়ার খেলায় দলগুলো ছোট থেকে আরও ছোট হচ্ছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ভোটের মাঠে প্রাপ্তি খুব একটা না থাকলেও দলটি এখন ভাঙনের মুখে। শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন, আর পদ-পদবির লড়াইয়ের কারণে প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরের মাথায় এসে ব্রাকেটবন্দি হচ্ছে গণফোরাম।
নতুন করে সংকট দেয়া দিয়েছে প্রবীণ রাজনীতিক রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টিতেও। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি থেকে বেরিয়ে গিয়ে এর সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন আলাদা দল গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর মধ্যেও ছোট দলগুলো ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও মূলত স্বার্থের দ্বন্দ্বেই ছোট দলগুলোতে চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে বড় ধরনের চিড় না ধরলেও ছোট দলের ঘর তছনছ হচ্ছে একের পর এক। এর মূলে কাজ করছে ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ, মোহ।
বৃহস্পতিবার তিনি আরও বলেন, দল ভাঙার যে সংস্কৃতি চলছে তা অপরাজনীতিরই প্রতিফল। দেশে এখন রাজনীতি নেই। ভোটাধিকার নেই। রাজপথে নামার সুযোগ নেই। কথা বলার সব পথ বন্ধ। ফলে দলগুলোর অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে বর্ধিত সভা আহ্বান করেছেন ড. কামাল হোসেন। একই দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ করারও ঘোষণা দিয়েছে গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশ। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গণফোরামের দুই অংশের নেতাকর্মীরা কার্যত এদিন প্রকাশ্যে মুখোমুখি হচ্ছেন।
এর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বর্ধিত সভা ডেকে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, সাবেক নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ। অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন দলের সাবেক এই তিন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন। ইতোমধ্যে গণফোরাম থেকে মহসিন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, ‘তাদের এ ধরনের সভা আহ্বান করার কোনো সাংগঠনিক বৈধতা নেই। তাই তাদের সভার সঙ্গে গণফোরামের কোনো সম্পর্ক নেই।
এ ব্যাপারে মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, গণফোরাম যেভাবে চলছে, সেভাবে একটি দল চলতে পারে না। একটি অর্থবহ পরিবর্তন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, বিতর্কিত লোকদের পরিহার করে দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেন তাদের সঙ্গে থাকবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
গণফোরাম সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, আসন ভাগাভাগি, জামায়াত ইস্যু, ভোটের ঠিক আগ মুহূর্তে বিভিন্ন দলের দলছুট নেতাদের গণফেরামে যোগদান, ভোটের পর শপথ নেয়া না নেয়া- নানান ইস্যুতে টানাপড়েন তৈরি হয় গণফোরামে। এর সঙ্গে যোগ হয় ভোটের আগ মুহূর্তে গণফোরামে যোগ দেয়া ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করা নিয়ে বিরোধ তীব্র হতে থাকে। যার রেশ হিসেবে ভাঙনের পথে নিয়ে যাচ্ছেন গণফোরামকে।
জানা গেছে, শুধু গণফোরামই নয়, ছোট ছোট আরও বেশ কিছু দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। দুই দফা ভাঙনের পর আবারও সংকটে পড়েছে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
দলটির হাজীগঞ্জ শাখা কমিটির সদস্য সুরুজ আলী মাতুব্বর সম্প্রতি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এখন আর শ্রমিক শ্রেণির পার্টি নয়, বরং এটা কতিপয় সুবিধাবাদী নেতৃত্বের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। আর তাই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সব রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করছি।’
অবশ্য সুরুজ আলী মাতুব্বরের এই অভিযোগ আমলে নিতে নারাজ রাশেদ খান মেনন। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘নানান অভিযোগের ভিত্তিতে সুরুজ আলী মাতুব্বরকে দল থেকে আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে।’ যদিও এর আগে আদর্শগত দ্বন্দ্বের কথা বলে কয়েক দফায় ভেঙেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
এর বাইরে গত বছরের ১৬ নভেম্বর ভাঙে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। দলের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে বাদ দিয়েই একই নামে আলাদা কমিটি ঘোষণা দেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। নতুন কমিটিতে আবদুল করিম আব্বাসীকে আহ্বায়ক করা হয়। এক পর্যায়ে এলডিপি বিএনপি থেকে বেরিয়ে গঠন করা অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ একীভূত হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরে দুই দল আলাদা হয়ে যায়। ২০০৪ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা গঠিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেয়া প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হওয়ার পর দফায় দফায় ভেঙেছে দলটি। জাসদের মূলধারার সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। ১৯৮০ সালে জাসদ প্রথম ভাঙনের কবলে পড়ে। জাসদ থেকে বেরিয়ে বাসদ গড়ে তোলা হয়। ১৯৮৬ সালে কাজী আরেফ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত দল জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০০২ সালে আ স ম রবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি গঠিত হয়। জেএসডি ভেঙে আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে আরও একটি জেএসডি গঠিত হয়েছে সম্প্রতি।
দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল (এমএল) সম্প্রতি দুই টুকরো হয়েছে। দিলীপ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সুবিধাবাদীর রাজনীতির অভিযোগ তুলে সাম্যবাদী দলকে ক্ষতি করে একটি অংশ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে গেছে। দিলীপ বড়ুয়া এখন নিজেই নেতা নিজেই কর্মী। এর বাইরে ভাগ হয়েছে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন। দলটির মহাসচিব পদে থাকা লায়ন এমএ আউয়াল একই নামে আলাদা দল গঠন করে নিজেই সভাপতি হয়েছেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ বিভক্ত হয়েছে ভোটের ঠিক আগ মুহূর্তে। অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামের একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন। কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ গঠনের পর ওই মঞ্চে অংশগ্রহণ নিয়ে বিরোধে জাগপা নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়ে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ লেবার পার্টিও দ্বিখণ্ডিত হয়েছে সম্প্রতি। কারণে অকারণে ভাঙাগড়া চলছেনই ছোট ছোট দলগুলোতে।