কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আরসার কমান্ডার নজিবুল্লাহসহ নিহত হয়েছেন ছয়জন। ক্যাম্পে অবস্থান করা ঘুমন্ত আরএসও সদস্যদের মারতে এসে উল্টো আরসার সদস্য নিজেরাই কুপোকাত হয়েছে বলে দাবি একাধিক অসমর্থিত সূত্রের। গত শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থলে তিনজন এবং হাসপাতালে দুজন মারা যান। বাকি আরেকজনের মরদেহ মিলেছে পাহাড়ের ঢালুতে এমনটি জানিয়েছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী। গোলাগুলিতে নিহতরা হলেন- আরসা কমান্ডার ক্যাম্প-১০ এর বাসিন্দা মো. নজিমুল্লাহ, আরসার জিম্মাদার ক্যাম্প-১৩ এর নুরুল আমিন (২৪), আরসার সদস্য ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২৪) ও মোহাম্মদ হামীম (১৬)। অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এছাড়া সন্ধ্যায় ১১ নম্বর ক্যাম্প এলাকার পাহাড়ের ঢালু থেকে সানা উল্লাহ (২৩) নামে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনিও সকালে গোলাগুলিতে আহতদের একজন বলে দাবি রোহিঙ্গাদের। ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, ভোরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারী আরসা ও আরএসওর মধ্যে গোলাগুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। তিনজনের মরদেহ পাওয়া যায়। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজন মারা যান। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয় টহলও। সূত্র মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্যানুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খান নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। আইসিসি টিম চলে যাওয়ার একদিন পর এ গোলাগুলির ঘটনাকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্যাতিতদের ডাকতে গিয়ে মো. এবাদুল্লাহ (২৭) নামের এক রোহিঙ্গা সাব মাঝি (নেতা) ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের দাবি, অধিকার নিয়ে কাজ করতে গঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে আরএসও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার বিষয় ও অধিকার নিয়ে কাজ করে। আর ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করছে আরসা। আরসার নিয়ন্ত্রণে থাকা সন্ত্রাসীরা মিয়ানমার সরকারের ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে কাজ করছে। প্রত্যাবাসনের আগ্রহী রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে হত্যা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে তারা। বৃহস্পতিবার আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের ক্যাম্প সফর ও বিচার কার্যক্রমের সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভয় দেখাতে এ হামলা বলে ধারণা রোহিঙ্গাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোলাগুলির বিষয়ে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন সদস্য ও রোহিঙ্গাদের কয়েকজন বলেন, শুক্রবার ভোরে আরসার অন্তত ৪০-৫০ জনের একটি সশস্ত্রদল ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টে ঘুমন্ত আরএসও সদস্যদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু আরএসওর সদস্যরা আগে থেকে এ হামলার খবর পেয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়। ভোর ৫টার দিকে আরসার সদস্যরা ক্যাম্পে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চারদিক থেকে ঘিরে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে আরএসওর সদস্যরা। এতে দুপক্ষের মধ্যে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময় হয়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে দুপক্ষই পালিয়ে যায়। ৮-এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, নিহতরা সবাই সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার সদস্য বলে জানতে পেরেছি। ভোরে সবাই যখন ঘুমে থাকে ঠিক এ সময় আরসার ৪০-৫০ জন অস্ত্রধারী একটি দল অতর্কিত হামলার উদ্দেশ্যে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। এ সময় আরসা বিরোধী হিসেবে পরিচিত আরএসও তাদের প্রতিরোধ করলে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। শোনা যাচ্ছে ঘুমন্ত আরএসওর সদস্যদের হত্যার জন্য ক্যাম্পে ঢুকেছিল আরসার সদস্যরা। তিনি আরও বলেন, আরসা সবসময় রোহিঙ্গাদের কাছে প্রত্যাবাসন বিরোধী হিসেবে পরিচিত এবং তারা মিয়ানমারের সরকারের হয়ে কাজ করে বলে দাবি করা হয়। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ক্যাম্প পরির্দশন ঘিরে রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখাতে এ হামলা। ফারুক আহমেদ বলেন, কে আরসা, কে আরএসও, সেটি বিষয় নয়। ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে না। যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। হত্যাকারীদের ধরতে অভিযান চলছে। এর আগেও ক্যাম্পে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একইভাবে গোলাগুলিতে অসংখ্য নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের অক্টোবরে উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদরাসায় ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ব্রাশফায়ার করেছিল দুর্বৃত্তরা। এ সময় তিনজন শিক্ষক ও এক ছাত্রসহ ছয়জন নিহত এবং কমপক্ষে ১২ জন আহত হন। কয়েকজনকে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে হামলাকারীরা। এরপর একসঙ্গে দুজনের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেনি।