(গড়াই নদীর ওপর নির্মিত সেতু কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন দুটি অংশের বাসিন্দাদের সড়কপথে যুক্ত করেছে।-নবচেতনা)
গড়াই নদীর ওপর নির্মিত একটি সেতু এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা ১১ ইউনিয়নের ১২ লাখ মানুষকে। তবে সেতুটির জন্য উপজেলাবাসীকে স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। করতে হয়েছে অনেক দেনদরবার। তাই এ সেতু প্রাপ্তির আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে সবাই। উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনকে যুগান্তকারী ঘটনা বলে দাবি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সাত লক্ষাধিক মানুষের। কেউ কেউ বলছে, এটি ঐতিহাসিক একটি স্বপ্নপূরণ। গড়াই নদীতীরে অবস্থিত কুমারখালী উপজেলায় মোট ১১টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে ছয়টি ছিল উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। আর পাঁচটি নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন ইউনিয়নগুলো হলো যদুবয়রা, পান্টি, চাঁদপুর, বাগুলাট ও চাপড়া। ইউনিয়নগুলোয় প্রায় সাত লাখ মানুষের বাস। উপজেলা সদরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ট্রলার ও নৌকা। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও গত বুধবার সেতুটি খুলে দেয়া হয়। এদিন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস তৈরি হয় দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে। নতুন এ সেতু ঘিরে কৃষক, ব্যবসায়ী, তাঁতি, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, শ্রমিকসহ সব শ্রেণীর মানুষ স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছে। উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেতু নির্মাণে চুক্তিমূল্য ছিল ৮৯ কোটি ৯১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৯১ টাকা। ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের পিসি গার্ডার সেতু ও প্রায় ৫৫০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল। দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় ঠিকাদারি কাজ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনা মহামারী ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। সংযোগ সড়কসহ সেতুটি শুরু হয়েছে কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া থেকে এবং শেষ হয়েছে যদুবয়রা ইউনিয়নের লালনবাজারে। সেতুটি টোল ফ্রি করা হয়েছে। ‘সেতু নির্মাণ ও টোল ফ্রি’র বিষয়ের স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জজ মনে করেন, এটি তার উপজেলার মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার। সেতুটি চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও কৃষিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। যদুবয়রা গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল মান্নান মাস্টার উপজেলা শহরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩৬ বছর ঝড়-বৃষ্টি, রৌদ্র-তাপে চরম দুর্ভোগ নিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে কর্মস্থলে গেছি। সবসময়ই আমার মনে হতো যদি এখানে সেতু নির্মিত হতো তাহলে এলাকার ছেলেমেয়েরা উপজেলা সদরে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারত। সেতু নির্মাণে যারপর নাই খুশি। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে এটা ভাবা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।’ চাপড়া গ্রামের ব্যবসায়ী জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী এ সেতু এলাকার ব্যবসা-বাণিজে নতুন গতি এনে দেবে। এ এলাকার মানুষ নদী পার হয়ে উপজেলা সদরে যাওয়ার চেয়ে জেলা শহরে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এখন ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। কৃষিপণ্য আনা-নেয়া সহজ হবে। বিশেষ করে অসুস্থ মানুষের হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য বেগ পেতে হবে না।’ কুমারখালী তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা। নদীর এপার-ওপার মিলিয়ে শত শত ছোট-বড় তাঁত শিল্প রয়েছে। এগুলো নতুন প্রাণ ফিরে পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চালু হওয়া সেতু দেখতে প্রতিদিনই দুই পাড়ের বাসিন্দারা আসছে। বিকাল বা সন্ধ্যায় সেতুর ওপর থেকে গড়াইয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। নবনির্মিত সেতুটি এলাকাবাসীর চিত্তবিনোদনেরও একটি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলেজ শিক্ষার্থী ইনায়েতপুর গ্রামের সেলিনা নাসরিন বলেন, ‘কলেজে যেতে প্রতিদিন নৌকা বা ট্রলারে গড়াই নদী পার হতে হতো। এখন নদীর মাঝখানে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি। কলেজে আসা-যাওয়া এখন ১৫ মিনিটের পথ, যা আগে ছিল প্রায় ২ ঘণ্টার।’ দেশ-বিদেশে খ্যাত কুমারখালীর বুলবুল টেক্সটাইলের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আবদুর রফিক বলেন, ‘প্রায় সাত লাখ মানুষ উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা সংযুক্ত হয়েছে। সময় ও খরচ দুই-ই কমে যাওয়ায় তারা এখন উপজেলা শহরে আসবে। এটা উপজেলার অর্থনীতির জন্য সুখবর।’ কুমারখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিমল কুমার বলেন, ‘নদীর কারণে অনেকেই ওপার থেকে আসতে পারত না। এরই মধ্যে অনেকেই যোগাযোগ করছে। সেতুটি চালু হওয়ায় গড়াই নদীর ওপারের শিক্ষার্থীরা এখন এসব স্কুলগুলোয় পড়তে সক্ষম হবে।’
উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুর রহিম জানান, সেতু খুলে দেয়া হয়েছে। পরে যেকোনো সময় এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।