কাটাতারের বেড়া দু-বাংলার মানুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে পারলেও ভাঙেনি তাদের ভাতৃত্বের বন্ধন। সীমান্তের এপার ওপারের মানুষের একে অপরের প্রতি ভালবাসা ও সাহায্য সহযোগীতার প্রচলন বহু আগে থেকেই। অবিভক্ত বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আজও ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের মেহেরপুর সীমান্তের মানুষের মর্যাদা অনেক। মেহেরপুরের অধিকাংশ পরিবারের আত্মীয়-স্বজন ভারতে বসবাস করে। ভারতের জীতপুর, তেহট্ট, মুর্শিদা বাদ থেকে দেশ ভাগের পর উঠে এসে মেহেরপুরে বসতি স্থাপন করেন অনেকেই। সীমান্তের দুই দেশের মানুষের মুখের ভাষাও অনেকটা একই রকম। সেই নাড়ির টান থেকেই ভারতীয়রা তাদের শত শত বিঘা জমি বাংলাদেশি কৃষকদের চাষের সুযোগ করে দিয়েছে। কাটাতারের বেড়ার বাংলাদেশ পারে ভারতীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি লিজ নিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার ফসল ঘরে তুলছে বাংলাদেশি কৃষকরা। কখন টাকা আবার কখনো ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমি মালিককে দিয়ে চলছে চাষাবাদ। সেই চাষাবাদে সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছে দু-দেশের সীমান্ত রক্ষিরা। এসব জমি চাষ করতে পেরে খুশি সীমান্তের কয়েকশ কৃষক। মেহেরপুর জেলার তিনদিকই ভারত বেষ্টিত। এই সীমান্তের ৪৭ কিলোমিটারে রয়েছে হাজার খানেক হেক্টর চাষাবাদের উপযোগী জমি। ভারতীয়রা যেমন তাদের অনাবাদি জমির মূল্য, দখল ও ব্যবহার সুবিধা পাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশিরা কম টাকায় ও ফসলের বিনিময়ে লিজ নিয়ে কোটি টাকার ফসল উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। জমিতে নতুন ফসল উঠলে বাংলাদেশি চাষিরা জমির মালিককে উপহার হিসেবেও পাঠান কেউ কেউ। এসব জমিতে উৎপাদিত সবজি ও ফসল মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়। বছর শেষে লাখ লাক টাকার লাভের মুখ দেখেন বাংলাদেশি চাষিরা। সীমান্তের চাষিরা বলছেন, এসব জমি না পেলে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতো না। নিরাপদে সীমান্তের এসব জমি চাষাবাদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। কৃষি বিভাগ ও বিজিবির হিসেবে ভারতীয়দের কয়েক হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদ করছেন বাংলাদেশিরা। মেহেরপুর সদর উপজেলার একেবারেই ভারত লাগোয়া সীমান্তবর্তী ইছাখালী গ্রামের কৃষক কালু মিয়া বলেন, সীমান্তবর্তী গ্রামের চাষিদের ভাগ্য পরির্বতন হয়েছে ভারতের জমি লিজ নিয়ে চাষ করে। একদিকে কম টাকায় লিজের জমি, অন্যদিকে সবজি ও ফসল উৎপাদন করে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি। আমি নিজেও প্রায় ১৮ বিঘা ভারতীয় মারিকানাধীন জমি চাষ করি। এসব জমির সবজি ও ফসল দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়। একই গ্রামের কৃষক আয়ূব হোসেন বলেন, ৩০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে আবাদ করছি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক ভালো। এসব জমিতে সব রকমের ফসল উৎপাদন করা যায়। ফসল উৎপাদন করে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। বছরে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকা দিতে হয় জমি মালিককে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় সবজীও দেওয়া হয় তাদের। সীমান্তবর্তী বুুড়িপোতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ জামান বলেন, ভারতীয় জমি চাষ করে বাংলাদেশি কৃষকরা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন। অনেক চাষি ভাগ্যের পরিবর্তনও করেছেন। দুই পারের মানুষের মাঝে সুসম্পর্ক আছে। এই চাষাবাদে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা ব্যাপক সহযোগিতা করে আসছে। এতে দুদেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে। এব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি কোন মন্তব্য না করলেও তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সীমান্তে কৃষকদের সহযোগীতা আমরা সবসময় করে থাকি। এছাড়াও সীমান্তে ফসল চাষ হলে সেখানে বন জঙ্গল হওয়ার সম্ভাবনা কম। সীমান্তে শান্তি বিরাজেও বড় ভূমিকা রাখে কৃষকরা। মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার বলেন, সীমান্তে ভারতীয় জমি লিজ নিয়ে চাষ করে মেহেরপুরের কৃষকরা ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছেন। এটি আমাদের জেলা ও দেশের জন্য পজিটিভ দিক। এতে অর্থনীতির দিক দিয়ে আমাদের দেশ লাভবান হচ্ছে।